Type Here to Get Search Results !

#in page push

আত্মীয়তার বন্ধনে গড়ে উঠে মিত্রতা

 আত্মীয়তার বন্ধনে গড়ে উঠে মিত্রতা



TufaniAnimator

প্রকাশ: 10 সেপ্টেম্বর 2024, 7.30


প্রথমে তাঁর নাম ছিল বাররা। বিয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) সেটি পাল্টে তাঁর নাম রাখেন জুওয়াইরিয়া। বাররা নামটিতে আত্মপ্রশান্তির ভাব থাকায় রাসুল (সা.) তাতে অশুভ ও অকল্যাণের ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তিনি সেটি পছন্দ করেননি। (মুসলিম, হাদিস: ২,১২০)

একদিন সকালে রাসুল (সা.) দেখতে পেলেন জুওয়াইরিয়া (রা.) মসজিদে বসে দোয়া করছেন। তিনি চলে গেলেন। দুপুরে এসে তাঁকে একই অবস্থায় পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি সব সময় এ অবস্থাতেই থাকো?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’

রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাকে এর চেয়েও ভালো কিছু শিখিয়ে দেব, যা তোমার এই নফল ইবাদতের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এরপর তিনি তাঁকে এই দোয়াটি শিখিয়ে দেন: ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি আদাদা খালকিহি ওয়া রিজা নাফসিহি ওয়া জিনাতা আরশিহি ওয়া মিদাদা কালিমাতিহি।’

অর্থাৎ: ‘আমি আল্লাহ–তায়ালার প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করছি, তাঁর সৃষ্টিকুলের সংখ্যার পরিমাণ, তিনি সন্তুষ্ট হওয়ার পরিমাণ, তাঁর আরশের ওজন সমপরিমাণ, তাঁর কথা লিপিবদ্ধ করার কালি পরিমাণ।’ (মুসলিম, হাদিস: ৭.০৮৮)

জুওয়াইরিয়া (রা.) ছিলেন আরবের দুর্ধর্ষ বনু মুসতালিক গোত্রের মেয়ে, যাঁরা যুদ্ধেই সবকিছুর সমাধান খুঁজতেন। জুওয়াইরিয়ার বাবা হারিস ইবন দিরার ছিলেন বনু মুসতালিক গোত্রের সর্দার।

জুওয়াইরিয়া বিনতে হারিস (রা.) প্রথমে তাঁর চাচাতো ভাই মুসাফি ইবন সাফওয়ানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর বাবা হারিস এবং স্বামী মুসাফি দুজনই ইসলামের বিরোধী ছিলেন।

মুহাম্মদ (সা.) মক্কার অন্যান্য গোত্রের মতো এই গোত্রকেও ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা তা গ্রহণ করেনি।

পঞ্চম হিজরির শাবান মাসে বনু মুসতালিকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে মুসলমানরা বিজয়ী হয় এবং জুওয়াইরিয়ার স্বামী নিহত হন। মুসলিমরা ৬০০ যুদ্ধবন্দীসহ প্রচুর গনিমতের সম্পদ লাভ করেন। বন্দীদের মধ্যে জুওয়াইরিয়া বিনতে হারিসও ছিলেন। সব বন্দীকে দাসদাসী ঘোষণা করে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। জুওয়াইরিয়া পড়েন সাবিত ইবন কায়েসের ভাগে।

গোত্রনেতার কন্যা জুওয়াইরিয়া দাসীর জীবন মেনে নিতে পারেননি। ইসলামি আইন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীরা মুকাতাবা বা চুক্তির মাধ্যমে মুক্তির সুযোগ পায়। জুওয়াইরিয়া (রা.) সাবিত ইবনে কায়েসের (রা.) কাছে মুক্তির জন্য চুক্তির আবেদন করেন। সাবিত (রা.) ৯ উকিয়া সোনার বিনিময়ে মুক্তির চুক্তি করেন। কিন্তু জুওয়াইরিয়ার কাছে সেই পরিমাণ অর্থ ছিল না। তিনি মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেন।

রাসুল (সা.) গনিমতের মাল বণ্টন শেষ করার পর জুওয়াইরিয়া তাঁর সামনে এসে বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমি আমার গোত্রপতি হারিস ইবন নিবারের কন্যা। মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে সাবিত ইবনে কায়েসের ভাগে পড়েছি। সাবিত আমার সঙ্গে চুক্তি করেছেন, কিন্তু আমি অর্থ পরিশোধ করতে পারছি না। আমি আপনার কাছে এই প্রত্যাশা নিয়ে এসেছি যে আপনি আমার চুক্তিবদ্ধ অর্থ পরিশোধে সাহায্য করবেন।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি কি এর চেয়েও ভালো কিছু আশা করো না?’

জুওয়াইরিয়া বললেন, ‘সেটা কী?’

রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি তোমার চুক্তির সব অর্থ পরিশোধ করে দিয়ে তোমাকে বিয়ে করি।’

এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে জুওয়াইরিয়া (রা.) দারুণ খুশি হয়ে সম্মতি দিলেন। রাসুল (সা.) তখন সাবিতকে ডেকে চুক্তির অর্থ তাঁকে দিয়ে জুওয়াইরিয়াকে (রা.) দাসত্ব থেকে মুক্তি করেন। এরপর তাঁকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন।

তাঁদের বিয়ের সময় নবী (সা.)-এর বয়স ছিল ৫৯ বছর, আর জুওয়াইরিয়া (রা.)-র বয়স ছিল ২০ বছর।

বিয়ের খবরে সাহাবিরা বললেন, রাসুল (সা.) যে গোত্রের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, সে গোত্রের কাউকে তাঁরা দাস হিসেবে ধরে রাখতে পারেন না। এরপর তাঁরা পরামর্শ করে একজোট হয়ে সব বন্দীকে মুক্ত করে দিলেন। এ উপলক্ষে বনু মুস্তালিকের ১০০ বাড়ির সব বন্দী মুক্তি পান।

বনু মুস্তালিকের গোত্রপতি জুওয়াইরিয়ার (রা.) বাবা হারিস মুক্ত হয়ে রাসুল (সা.)–এর কাছে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তা দেখে বনু মুস্তালিক গোত্রের ভেতরে ইসলাম গ্রহণের তাগিদ শুরু হয়।

আরবের বিশাল এক শক্তি রাসুলের (সা.) শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ইসলামের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হলো। বিয়েটি ইসলামের প্রচার ও নিরাপত্তার জন্য বিরাট কল্যাণ বয়ে নিয়ে এল। আত্মীয়তার সূত্রে গড়ে উঠল মিত্রতা।

আল্লাহর নবীর সংস্পর্শে এসে জুওয়াইরিয়া (রা.) একজন আদর্শ নারীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। ইসলামের আদর্শ তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠেছিল।

রাসুল (সা.) জুওয়াইরিয়াকে (রা.) ভালোবাসতেন। একবার তাঁর ঘরে এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘খাওয়ার কিছু আছে?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘আমার দাসী কিছু সাদকার গোশত দিয়েছিল, শুধু তা–ই আছে। এ ছাড়া আর কিছু নেই।’

রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাই নিয়ে এসো। কারণ সাদকা যাকে দেওয়া হয়েছিল, তার কাছে পৌঁছে গেছে।’

জুওয়াইরিয়া (রা.) রাসুলুল্লাহর (সা.) সাতটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।

একাধিক হাদিসের বর্ণনায় জানা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই তাঁর কাছে এসে তাঁকে তাসবিহ ও তাহলিলে মশগুল দেখতে পেতেন। মানুষ তাঁর সঙ্গে কথা বললে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। তাঁর বিয়ের পাঁচ বছর পর রাসুল (সা.) ইন্তেকাল করেন।

রাসুলের (সা.) ইন্তেকালের পরে এই নারী ভেঙে পড়েননি। তিনি তাঁর জীবন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টায় ব্যয় করেছিলেন। আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘আমি কোনো নারীকে তাঁর সম্প্রদায়ের জন্য জুওয়াইরিয়ার চেয়ে বেশি কল্যাণময়ী দেখিনি।’

জুওয়াইরিয়া (রা.) হিজরি ৫০ সনে রবিউল আওয়াল মাসে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। মদিনার গভর্নর মারওয়ান তাঁর জানাজা পড়ান। মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে তাঁর কবর রয়েছে।

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Below Post Ad